কর্ম জীবনে সফলতার মূল মন্ত্র
কর্মক্ষেত্রে সবাই সবধরনের দক্ষতার অধিকারী হয়না। কিছু কিছু দক্ষতা কর্মী নিজ প্রয়ােজনে রপ্ত করে , আর কিছু কিছু দক্ষতা প্রতিষ্ঠান প্রশিক্ষন বা কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে রপ্ত করতে সহায়তা প্রদান করে থাকে। এক্ষেত্রে একই ধরনের প্রশিক্ষন সবার জন্য প্রযােজ্য নাও হতে পারে। ব্যক্তি বা পদবী ভেদে প্রশিক্ষন বা কাউন্সেলিং এর ভিন্নতাও হতে পারে। কোন কর্মীকে কি ধরনের প্রশিক্ষন প্রদান করতে হবে তা পূর্ব নির্ধারিত হওয়া প্রয়ােজন। রাতারাতি কর্মীদের মধ্যে পরিবর্তন আনয়ন করা সম্ভব নয়। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
কিন্তু কিছু দক্ষতা আছে যেগুলো রপ্ত করলে আপনার কর্ম জীবনে আপনি অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকবেন। প্রায় সকল কর্ম ক্ষেত্রেই নিচের দক্ষতা গুলো খুব জরুরি হয়ে পরে।
১) কথা বলার দক্ষতা/ভাষা ব্যবহারের দক্ষতাঃ
উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সহকর্মী এবং কর্মীদের সাথে কার্যকরভাবে যােগাযােগ রক্ষা করা অপরিহার্য। ডিজিটাল যুগে কর্মীদের অবশ্যই জানতে হবে কিভাবে ফোন, ইমেইল এবং সােশ্যাল মিডিয়াতে তথ্য আদান প্রদান করতে হবে। ভাল মৌখিক যােগাযােগ মানে কথা কম বা বেশী বলা না। ব্যক্তিগতভাবে বা ফোনে অথবা ইমেইল-এ কারাে সাথে কথা বলার সময় সরাসরি স্পষ্টভাবে বলার চেষ্টা করতে হবে। কর্তৃপক্ষ, সহকর্মী বা কর্মীদের সাথে মতের মিল না হলেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। কারাে সাথে কোন কিছু বলার আগে অবশ্যই ঐ বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে যা অতিরিক্ত কথা বলা বা শ্রোতাদের বিভ্রান্তি এড়াতে সাহায্য করবে । গালিগালাজ, দুর্ব্যবহারের পরিবর্তে বন্ধুত্বপূর্ন আচরন, একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন বা একটু হাসির মাধ্যমে সহকর্মীদের মন জয় করা সম্ভব। অন্যদের সাথে আত্মবিশ্বাসের সাথে কথা বলতে হবে যেন তারা বিশ্বাস করে আপনি যা বলছেন তা আপনি নিজে বিশ্বাস করেন ও অনুসরনও করেন।
২) পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানােঃ
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়ানো একজন কর্মীর সফলতার মূল মন্ত্র । প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত আসবে সেই সব সিদ্ধান্তের সাথে আন্তরিকভাবে নিজেদের এবং সহকর্মীদের মানিয়ে নেয়ার চেষ্টার মাধ্যমে একজন নেতা হিসেবে নিজেকে সফলভাবে কর্তৃপক্ষের নিকট উপস্থাপন করা সম্ভব। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়ানাের মানসিকতা থাকতে হবে । পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহন করতে হবে, এর মাধ্যমে একজন কর্মীর সমস্যা সমাধানের দক্ষতা প্রদর্শনের সুযােগ সৃষ্টি হয় । যখনই কোন সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয় সেই সিদ্ধান্তকে সহকর্মী ও কর্মীদের নিকট ইতিবাচক হিসেবে উত্থাপন করতে হবে এবং তাদেরকে নিয়েই সিদ্ধান্তকে সফলতার সাথে প্রয়ােগ করতে হবে ।
৩) আত্ম সংযম/ধৈৰ্য্যঃ
কর্মক্ষেত্রে ধৈৰ্য্য একটি গুরত্বপূর্ন গুন। এটি হতাশা, দ্বন্দ্ব এড়িয়ে নিজেকে ভাল কাজের দিকে পরিচালিত করতে সহায়তা করে এবং ব্যক্তিগত ও কর্ম জীবনে লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে। কর্মক্ষেত্রে কাজ এবং চ্যালেঞ্জ গ্রহন করার মধ্য দিয়েই ধৈর্য্যের অনুশীলন করতে হবে, এমনকি অপ্রাসঙ্গিক কোন সিদ্ধান্ত বা পরিস্থিতি নিয়ে যদি কর্তৃপক্ষ বা সহকর্মী আলােচনা করে তা ধৈৰ্য্য নিয়ে শুনতে হবে এবং পজিটিভলি নিজের মতামত প্রকাশ করতে হবে। এমনকি কঠিন পরিস্থিতিতেও ধৈর্য্য ধারন করে আত্মবিশ্বাসের পরিচয় দিতে হবে । সুতরাং, কর্মজীবনকে বিকশিত করতে হলে আগে সমস্যাকে ধারন ও গ্রহন করতে হবে তারপর সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। একজন দক্ষ ও অদক্ষ কর্মীর মধ্যে ধৈৰ্য্য একটি বড় পার্থক্য।
৪) দায়িত্ব পালনের মানসিকতাঃ
মননশীলতা অনুশীলন করা শুধুমাত্র কর্মীদের জন্য শারীরবৃত্তিয় সুবিধা দেয় না বরং তাদের কর্মক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে । মননশীলতা একটি সুস্থ সম্পর্ক ও একটি সুষ্ঠ কর্মপরিবেশের দিকে চালিত করতে সাহায্য করে। কর্মীদের মানসিকতা উন্নয়নে প্রশিক্ষন ও কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে যেন একজন কর্মী যেকোন দায়িত্ব পালনে বা সিদ্ধান্ত গ্রহনে পজিটিভ মানসিকতার পরিচয় দেয় এবং কঠিন পরিস্থিতিতেও ইতিবাচক সাড়া দিতে পারে। একজন স্ব প্রেষিত কর্মী কোন বিচার ছাড়াই যে কোন সিদ্ধান্তের প্রতি গভীর মনােযােগ প্রদান করে। কাজের সফলতা অনেকাংশেই মানসিকতার উপর নির্ভরশীল। মননশীলতা কর্মীদের মাঝে যােগাযোগ উন্নীত করে হতাশা, উদ্বেগ, দ্বন্দ্ব হ্রাস করে।
৫) শ্রবণ ক্ষমতা/মনােযােগঃ
তথ্য প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান বিশ্বে একটি নির্দিষ্ট কাজে মনােযোগ দেয়া কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে। একটি নিদিষ্ট কাজে মনােযােগ প্রদান করলে সেই কাজটি সুষ্ঠভাবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পাদন করা সম্ভব । কোন কাজে মনােযােগ দিলে আশেপাশের যে বিষয়। গুলাে মনােযােগে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে তা পরিহার করতে হবে । কাজগুলােকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। একই সময় একটি বিষয়ের উপর মনােনিবেশ করতে হবে। বিভিন্ন কাজের জন্য সময় ভাগ করে নিতে হবে যেন প্রতিটি কাজের জন্য গভীর মনােযােগ দেয়া যায় । যেকোন নির্দেশনা বা কথোপকথন মনােযােগ দিয়ে শুনতে হবে । কথােপকথনের বিষয়বস্তু অনুধাবনের চেষ্ট করতে হবে ।
৬) সময় ব্যবস্থাপনাঃ
সময় ব্যবস্থাপনা কর্মক্ষেত্রে কর্মক্ষমতা এবং উৎপাদনশীলতা প্রভাব বিস্তার করে। এটি কর্মচারীদের দক্ষতা উন্নয়ন ও সময়ের আগে কাজ সম্পাদন করা সম্ভব। প্রথমে নির্ধারন করতে হবে কর্মীগন তাদের সময় কিভাবে ব্যয় করছে । দৈনিক কর্মসূচী তৈরী করে সেই মােতাবেক অনুসরন করতে হবে এক্ষেত্রে বিভাগ/শাখা প্রধানগন তাদের অধীনস্থদের এ ব্যাপারে সাহায্য সহযােগীতা করতে পারেন । কাজের অগ্রাধিকার নির্ধারন করতে হবে। একই সময়ে অনেক ধরনের কাজ করা থেকে বিরত রাখতে হবে এবং প্রতিটি কাজের জন্য আলাদা আলাদা সময় নির্ধারিত করতে হবে ।
৭) কথা শুনার মানসিকতা/অনুভূতিহীনঃ
যখন কোন কর্মীকে কেউ তার কাজের জন্য বা দক্ষতার জন্য অপমান করে তখন সে আঘাত পেতে পারে এবং রাগের বশবর্তী হয়ে অনাবশ্যক ঘটনার সাথে জড়িয়ে পরতে পারে যা কর্মীর জন্য কর্মজীবনকে শেষ করে দিতে পারে । কিন্তু এই ধরনের অনাবশ্যক ঘটনা এড়িয়ে চলার জন্য অনুভূতিহীন হওয়া আবশ্যক, অর্থাৎ যে যাই বলুক না কেন কর্মীদের তাদের লক্ষ্যে অভিষ্ট থেকে এগিয়ে যাওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে কাজ করলে সেই কাজে ভুল থাকবেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। কাষ্টমার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে কোনরুপ বিরুপ মন্তব্য শুনলে তাতে কোনরুপ প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে নতুন উদ্যমে কিভাবে আরাে ভালাে সার্ভিস প্রদান করা যায় তাতে মনােনিবেশ করতে হবে। অপমান বা নেগেটিভ কথাবার্তাকে আমল না দিয়ে নিজের সেরাটাই প্রদান করতে হবে। অপমান, সমালােচনা সাধারনত আঘাত করার জন্যই করা হয়ে থাকে, কখনও কখনও অপমানকারী অনেক নির্মম হয়। | যেহেতু কটু কথা কখনই গঠনমূলক হয়না সেহেতু এগুলাে মনে না নেয়াই উত্তম।
৮) সমস্যা সমাধানের দক্ষতাঃ
এন্ট্রি লেভেল থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপক পর্যন্ত সকলের নিকট সমস্যার সমাধান করা কাজেরই একটি অংশ। তাই প্রত্যেকটি কর্মীর। সমস্যার মলে গিয়ে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। সমস্যার সমাধান হলাে একটি চ্যালেঞ্জ কে বুঝা এবং কার্যকর সমাধান খোঁজার একটি প্রক্রিয়া । প্রথমে সমস্যাটি নির্ধারন করতে হবে। এক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিশ্লেষন করতে হবে। একটি ছােট খাটো পরিস্থিতিও বড় সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। প্রতিটি সমস্যা চিহ্নিত করতঃ কারন নির্ধারন করতে হবে। সমস্যার কারনে যে সকল কর্মীরা আক্রান্ত তাদের মতামত গ্রহন করতে হবে। সেই মতামত বিশ্লেষন পূর্বক সমস্যার উৎস বের করতে হবে। অতঃপর প্রতিষ্ঠানের নীতি ও পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে একাধিক সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। একাধিক সমাধান থেকে কার্যকরী সমাধানটি প্রয়ােগ করে অগ্রগতি নিরীক্ষনপূর্বক সমন্বয় করতে হবে।
৯) সততাঃ
কথায় আছে সততাই সবেকৃষ্ট পন্থা। কখনও কখনও কর্মীগন প্রতিষ্ঠানের অপারেটিং পদ্ধতি আধুনিকায়ন বা পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে সততার সাথে নিজেদের অভিজ্ঞতা, হতাশা প্রকাশ করতেও দ্বিধা বােধ করে। প্রকৃতপক্ষে সততা প্রতিষ্ঠানের প্রতি আল্লতে বহিঃপ্রকাশ | সত্য প্রকাশ সমস্যা চিহ্নিতকরনে সহায়তা করে । সততা সততাকেই উৎসাহিত করে। কোন বিভাগ/শাখার ব্যবস্থাপক যদি সততার সাথে নিজের কাজ তথা জীবনকে পরিচালিত করে তাহলে তার অধীনস্থরাও তাকে অনুসরন করতে বাধ্য। কর্মীদের কথা এ কাজের মাধ্যমে তার সততা বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান যদি সততাকে উৎসাহিত করে এবং অসততাকে নিরুৎসাহিত করে তাহলে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানে একটি সুষ্ঠ কর্ম পরিবেশ বিরাজ করবে। পাশাপাশি গ্রাহকদের কাছ থেকে বিশ্বাস অর্জন করতে হলে বিশ্বস্ততার সাথে সেবা প্রদান করতে হবে। এটি একদিনে অর্জন করা সম্ভব নয় প্রতিদিন একটি একটি করে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হবে। যে গ্রাহক আপনার পরিসেবায় সন্তুষ্ট তারা অন্যদের কাছেও আপনাদের সেবার গুনগান করবে। এটি একটি প্রতিষ্ঠান এবং গ্রাহকের মধ্যে সৎ এবং সত্যবাদী বন্ধনের ফলাফল । কর্মচারী প্রতিষ্ঠানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যমেও সততা প্রকাশ পায়। শুধু মিথ্যা কথা না বল্লেই সততা প্রকাশ পায় না বরং দৈনন্দিন জীবন যাপনের প্রতিটি পদক্ষেপেই সততাকে ধারন ও পালন করাই আসল সততা।
১০) কম্পিউটার/প্রযুক্তিগত দক্ষতাঃ
নিয়ােগকারী কর্তৃপক্ষ এমন লােক সন্ধান করে যারা কাজের প্রথম দিনই ঝাপিয়ে পরতে পারে এবং প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা শুরু করতে পারে। তার মানে কাজটি সম্পন্ন করার জন্য সঠিক প্রযুক্তিগত দক্ষতা সহ কর্মী নিয়ােগ করা । প্রযুক্তিগত দক্ষতা নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন করার জন্য প্রয়ােজনীয় ক্ষমতা এবং জ্ঞান। এগুলাে ব্যবহারিক, যান্ত্রিক, তথ্য প্রযুক্তিগত প্রভৃতি হতে পারে। যদিও প্রায়শই প্রযুক্তিগত দক্ষতা (আইটি) চাকুরীর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন, সুতরাং কর্মীদের কাজের সাথে সম্পর্কিত প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকা উচিত।
১১) দলীয়ভাবে কর্ম সম্পাদনের দক্ষতাঃ
টীম ওয়ার্ক হলাে যখন একদল ব্যক্তি সমষ্টিগত লক্ষ্যে বা একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য সহযােগীতামূলক এবং দক্ষতার সাথে কাজ করে। যে কোন প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের জন্য টীম ওয়ার্ক অপরিহার্য। ক্লায়েন্ট , সহকর্মী এবং কর্মীদের সাথে সহযােগীতামূলকভাবে দৈনন্দিন কাজ গুলাে অতি সহজেই শেষ করা যায় এবং ধারাবাহিকভাবে লক্ষ্য গুলাে পূরন করা সহজতর হয়। যে সকল কর্মপরিবেশ টাম ওয়ার্ককে গুরুত্ব দেয়া হয় তা কর্মীদের , সহকর্মীদের প্রতি আস্থা তৈরী করতে এবং পেশাদার সততা গড়ে তুলতে অনুপ্রানিত করে ।
